
নিউ ইয়র্ক সফর
নিউ ইয়র্ক সিটি সফরের পেছনে অনেক কারণ থাকতে পারে। এটি হতে পারে সরকারি, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক কিংবা শিক্ষার উদ্দেশ্যে। কিন্তু যেকোনো উদ্দেশ্যেই হোক, নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ কোনো সহজ ব্যাপার নয় এবং সবাই এ সুযোগ পায় না। এটি আসলে ভাগ্য এবং সুযোগের বিষয়। প্রতি বছর অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনার জন্য নিউ ইয়র্কে যায়। বাংলাদেশের অনেক ব্যবসায়ীও ব্যবসার কারণে নিউ ইয়র্ক সফর করে থাকেন। এছাড়া কেউ ভাগ্যবান হলে এবং আমেরিকার ভিসা পেলে দর্শনার্থী হিসেবেও নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ সম্ভব। তবে সরকারী প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে নিউ ইয়র্ক সফর করা বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিকের জন্য বড় সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হয়। আর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সরকারি দলের সদস্য হিসেবে যোগদান করা একাধারে গৌরব ও সৌভাগ্যের বিষয়।
প্রতি বছর সরকারের প্রধান সাধারণ পরিষদের বৈঠকে যোগ দিতে নিউ ইয়র্ক সফর করেন এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর বিশিষ্টজনদের নিয়ে যান, যার মধ্যে সরকারি কর্মকর্তারাও থাকেন। একসময় এটি যেন এক ধরনের ফ্যাশনে পরিণত হয়েছিল—বড় একটি প্রতিনিধিদল নিয়ে নিউ ইয়র্ক যাওয়া। শেখ হাসিনা প্রতি বছর সাধারণ পরিষদের বৈঠকে অংশ নিতে নিউ ইয়র্কে যেতেন এবং অনেক বড় একটি দল নিয়ে যেতেন, যা একসময় নিয়মিত প্রথায় পরিণত হয়েছিল।
গত বছর ড. ইউনূস সাধারণ পরিষদের বৈঠকে যোগ দিতে নিউ ইয়র্ক সফর করেছিলেন এবং তিনি শুধু ছাত্রনেতা মাহফুজ আলমকেই সঙ্গে নেননি, বরং তাঁকে ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের মূল নকশাকার হিসেবেও পরিচয় করিয়ে দেন। এর পেছনে কিছু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে, যা আগে কেউ জানত না।
এবার ড. ইউনূস দেশের তিন রাজনৈতিক পক্ষের ছয়জন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে সঙ্গে নিয়েছেন, যারা বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ। ধারণা করা হয়, তাদের কোনো সরকারি দায়িত্ব নেই; বরং সৌভাগ্যক্রমে তারা সফরসঙ্গী হতে পেরেছেন। ইতিমধ্যেই তাদের সফরের কারণ নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে মনে করেন, ড. ইউনূস দেশের গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গে জাতীয় ইস্যু নিয়ে আলোচনা করার এ সুযোগ নিয়েছেন। এমনকি আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতেও তিনি এ সফরের সুযোগ কাজে লাগাতে পারেন।
এর মাধ্যমে রাষ্ট্রপ্রধানের সরকারি সফরে রাজনৈতিক নেতাদের অন্তর্ভুক্তির নজির সৃষ্টি হলো। এটি সম্ভবত রাজনৈতিক কারণে হয়েছে। কারণ, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের অংশীদাররা নির্বাচন ও সাংবিধানিক নানা বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে পারেননি। তাই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া প্রয়োজন বলে মনে করা হচ্ছে।
স্পষ্ট যে রাজনৈতিক অংশীদাররা নিজেদের দলীয় স্বার্থেই কাজ করছেন, বিপ্লবের চেতনাকে ভুলে গিয়ে। হয়তো মূল নকশাকার চান তারা যেন মিলেমিশে কাজ করে। কিন্তু এতদিন সরকারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে তাদেরকে অভিন্ন প্ল্যাটফর্মে আনার ক্ষেত্রে। অথচ এখন তাদেরকে একটি অভিন্ন লক্ষ্যে আনা খুব জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ধারণা করা হচ্ছে, মূল নকশাকার তাদেরকে বৃহত্তর বিপ্লবের স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করার দিকনির্দেশনা দেবেন। বর্তমান নিউ ইয়র্ক সফরের পেছনে এ অনুমানকে একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যেহেতু বাংলাদেশের বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলো ঢাকায় নয়, দেশের বাইরে নেওয়া হয়—এবারও একই প্রথা বজায় থাকতে পারে।
এই সফরে জনসংযোগ (PR) বিষয়গুলো নিষ্পত্তি হবে বলে মনে করা হচ্ছে এবং নিম্নকক্ষে আসন বণ্টনও এখানেই নির্ধারণ হতে পারে। অনেক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু নিউ ইয়র্ক সফরের সময় আলোচিত ও সমাধান হতে পারে, আসল নকশাকারকে কেন্দ্র করে।
রোহিঙ্গাদের জন্য জাতিসংঘ প্রস্তাবিত মানবিক করিডোর বিষয়টিও আলোচনায় অগ্রাধিকার পাবে। এ প্রস্তাবে সম্মত হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। তবে মনে রাখা উচিত, কোনো কিছু কখনো স্বার্থ ছাড়া হয় না।
একটি দরিদ্র জাতি হিসেবে আমাদেরকে পশ্চিমা দেশগুলোর, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন অর্জন করতে হবে। আমরা আন্তরিকভাবে আশা করি, বর্তমান নিউ ইয়র্ক সফরটি হবে ফলপ্রসূ ও সফল।