চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ
ব্যক্তিগত জীবন ও জাতীয় জীবনে চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। একটি জাতি একই সময়ে যেমন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগের মুখোমুখি হতে পারে, তেমনি আলাদাভাবেও আসতে পারে। কিন্তু কিভাবে একটি জাতি সেই চ্যালেঞ্জগুলো অতিক্রম করে এবং সুযোগগুলো কাজে লাগায়, সেটিই মূল বিষয়। আমরা একটি জাতি হিসেবে অতীতে যেমন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি, তেমনি সুযোগও পেয়েছি। দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখনো একটি সত্যিকারের জাতি হিসেবে স্থির হতে পারিনি। কবে তা সম্ভব হবে কেউ জানে না, এবং এটি গোটা জাতির জন্য উদ্বেগের বিষয়।
দক্ষিণ এশিয়ার বাঙালি মুসলমানরা অতীত ইতিহাসে চ্যালেঞ্জ ও সুযোগের সবচেয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গেছে। মুসলমানরা এখানে বিজয়ী হিসেবে এসেছিল, কিন্তু নিজেদের ভুলের কারণে তারা সুযোগ হারায় এবং প্রায় দুই শতাব্দী ধরে জীবনে নানা চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। শুধু নতুন ইংরেজ শাসকদের কাছ থেকেই নয়, হিন্দু সম্প্রদায় থেকেও তারা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে, যারা ব্রিটিশ শাসনামলে সমাজের সবচেয়ে সুবিধাভোগী শ্রেণীতে পরিণত হয়েছিল।
পাকিস্তানের জন্ম বাঙালি নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর জন্য এক সুবর্ণ সুযোগ হয়ে এসেছিল—উন্নত ভবিষ্যতের আশায়। মাত্র চব্বিশ বছরের মধ্যে তারা সমাজে মধ্যবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণীতে উন্নীত হওয়ার সুযোগ পায়। এটি সম্ভব হয়েছিল দুটি কারণে। প্রথমত, বাঙালি মুসলমানরা হিন্দু জমিদারদের শোষণ থেকে মুক্ত হয়, যা সম্ভব হয়েছিল ১৯৫০ সালের স্টেট অ্যাকুইজিশন অ্যান্ড টেন্যান্সি অ্যাক্ট-এর কারণে। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তান সরকারের উদ্যোগে বাঙালিদের উন্নয়নের জন্য যে সহায়তা প্রদান করা হয়েছিল, তা ব্রিটিশ আমলে কখনো ভাবাও যায়নি।
কিন্তু অচিরেই তাদেরকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। ভারত তার স্থানীয় দোসরদের মাধ্যমে তথাকথিত বাঙালি জাতীয়তাবাদের নামে হস্তক্ষেপ শুরু করে। পূর্ব পাকিস্তানের সরল-সাধারণ মুসলমান জনগণ নিজেদের নেতাদের দ্বারা ভুল পথে পরিচালিত হয় ও প্রতারিত হয়। তবুও ভাষা আন্দোলনের ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ গতি পায় এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের জন্ম দেয়।
বাংলাদেশ এক সুযোগ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও, তা দ্রুতই হারিয়ে যায় আমাদের নিজেদের নেতাদের ব্যর্থতার কারণে, যাদের স্বাধীন দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা ছিল না। আবারো সুযোগ আসে, তবে সঙ্গে কঠিন চ্যালেঞ্জও আসে। এই সময়ে জিয়াউর রহমানের মতো একজন মহান নেতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আবির্ভূত হন এবং প্রমাণ করেন যে তিনি দেশের একমাত্র সক্ষম নেতা।
বাংলাদেশের মানুষ একের পর এক নানা চ্যালেঞ্জ দেখেছে, তবুও আমরা কোনোভাবে জাতি হিসেবে টিকে আছি। আগস্ট ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলার মাধ্যমে সরকার ও জনগণ ভয়াবহ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। অনেকের বিশ্বাস, এটি ভারত করেছিল শুধু সরকারের নেতৃত্ব ও সংকট মোকাবিলার ক্ষমতা যাচাই করার জন্য। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির বিডিআর বিদ্রোহ জাতির জন্য আরেকটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। অনেকে মনে করেন এটি বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে দুর্বল করার জন্য ভারতের একটি পরিকল্পিত উদ্যোগ ছিল।
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনে জনগণ প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের আশা হারিয়ে ফেলে। কিন্তু জুলাই বিপ্লব ২০২৪ শুধু রাজনৈতিক পরিবর্তনই আনেনি, শেখ হাসিনাকেও দেশত্যাগে বাধ্য করেছে। একইসঙ্গে ভারতের আধিপত্যমূলক নিয়ন্ত্রণেরও অবসান ঘটেছে। এটি নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের মানুষের জন্য নতুন সুযোগের দ্বার উন্মোচন করেছে, তবে সঙ্গে এনেছে নতুন চ্যালেঞ্জও।
বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো বহুমুখী এবং সেগুলো রাতারাতি অতিক্রম করা সম্ভব নয়। অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক—উভয় ধরনের চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান এবং এগুলোর মোকাবিলায় অত্যন্ত সক্ষম নেতৃত্বের প্রয়োজন। ড. ইউনূস আন্তর্জাতিকভাবে জ্ঞান ও কাজের জন্য খ্যাতিমান হলেও, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র দেশ পরিচালনার অভিজ্ঞতা তার নেই। তার দলের অধিকাংশ সদস্য নবীন এবং এখনো কাঙ্ক্ষিত ফলাফল দিতে পারেনি।
দেশের পুরো বেসামরিক প্রশাসন দীর্ঘদিন ফ্যাসিবাদী শাসনের স্বার্থে গড়ে তোলা হয়েছে। এটিকে একটি শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য সম্পূর্ণ পুনর্গঠন প্রয়োজন। চট্টগ্রাম পাহাড়ি এলাকা (সিএইচটি) দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশের জন্য একটি অমীমাংসিত সমস্যা। এটি ভারতের তৈরি এবং বর্তমানে তারাই এটিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি খাগড়াছড়িতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোও ভারতের নকশার অংশ হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে—অঞ্চলের আইনশৃঙ্খলা অস্থিতিশীল করার জন্য।
রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘদিন ধরে ভয়াবহ মাথাব্যথা হয়ে আছে। এর সমাধান বর্তমানে অত্যন্ত অনিশ্চিত এবং জটিল কাজ। এটি তখনই সম্ভব হবে যখন আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো আন্তরিক ও কার্যকর পদক্ষেপ নেবে, অন্যথায় এটি বাংলাদেশের জন্য এক গুরুতর ক্ষত হিসেবেই থেকে যাবে। আমাদের একার প্রচেষ্টায় নিকট ভবিষ্যতে কোনো সফলতা আসবে না।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কক্সবাজার অঞ্চলে যে পদক্ষেপ নিয়েছে, তা তাদের গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। তারা রাখাইন জনগোষ্ঠী নিয়ে সিরিয়াস এবং আরাকান আর্মিকে সমর্থন অব্যাহত রাখবে। বাংলাদেশ রাখাইন জনগণের জন্য প্রস্তাবিত মানবিক করিডোরকে না বলার অবস্থায় নেই। এমনও হতে পারে যে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উস্কানি দেবে। কিন্তু বাংলাদেশ কোনোভাবেই যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত নয়, এবং এটি জাতির জন্য আত্মঘাতী পদক্ষেপ হবে। আমাদের অবশ্যই সব রকম প্রলোভন থেকে দূরে থাকতে হবে। প্রয়োজনে চীনের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের চাপ মোকাবিলায় সহায়ক হতে পারে। বাংলাদেশ সদ্য ঘোষিত সৌদি–পাকিস্তান প্রতিরক্ষা চুক্তিতে যোগ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে, যা জ্বালানি নিরাপত্তা ও সামরিক উন্নয়ন উভয় ক্ষেত্রেই সুফল বয়ে আনবে। এ ধরনের পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের বড় কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।
রাজনৈতিক দল ও পুরো জাতিকে অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে, যাতে আমরা জুলাই বিপ্লব ২০২৪-এর মাধ্যমে অর্জিত সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারি এবং ভবিষ্যতের যেকোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম হই।