
আমাদের একজন ত্রাণকর্তা প্রয়োজন
একজন সত্যিকারের নেতা একটি জাতিকে সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারেন, এবং তিনি সাধারণত সংকটের সময়েই আবির্ভূত হন। আমরা একটি জাতি হিসেবে অতীতে একের পর এক সংকটের মুখোমুখি হয়েছি, কিন্তু কিছু মহান ব্যক্তিত্ব এগিয়ে এসে আমাদের সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে রক্ষা করেছেন। ইতিহাস আমাদের জানাতে পারে কে আমাদের রক্ষা করেছিলেন, কিন্তু সমান গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—আমরা ইতিহাস পড়া প্রায় ভুলে গেছি।
ইতিহাস সবসময়ই একটি জাতিকে সঠিক পথ খুঁজে পেতে সাহায্য করে যখন তারা সংকটকাল অতিক্রম করে। ভারতের মুসলিম সমাজ ক্ষমতা হারানোর পর (১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধে নিজেদের ভুলের কারণে) এক গভীর সংকটে পতিত হয়। ইংরেজ শাসনের প্রথম একশ বছর তারা বাধ্য হয়েছিল নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে।
ব্রিটিশ সরকার ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের জন্য ভারতীয় মুসলমানদেরকে মূল ষড়যন্ত্রকারী মনে করেছিল, এবং সেই কারণে সরকারের কঠোর হাত সবচেয়ে বেশি পড়ে মুসলমানদের ওপর। ১৮৫৭ সালের প্রথম স্বাধীনতা যুদ্ধের পর তারা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হয়। তখন হঠাৎ একজন মহান ব্যক্তি ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন—তিনি হলেন **স্যার সায়েদ আহমদ খান**। তিনি তাঁর লেখনীর মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারকে বোঝাতে সক্ষম হন যে মুসলমানরাও ব্রিটিশ শাসনের প্রতি অনুগত।
**আলিগড় আন্দোলন**–এর মাধ্যমে তিনি ভারতীয় মুসলমানদের রাজনীতি থেকে বিরত থেকে আধুনিক শিক্ষা অর্জনের আহ্বান জানান, যদি তারা টিকে থাকতে চায়। এটি অত্যন্ত সফল হয় এবং আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা বিস্তারে বিরাট ভূমিকা রাখে। বাংলার নবাব আবদুল লতিফ এবং স্যার সায়েদ আমির আলীও এই একই মিশনকে সামনে নিয়ে এগিয়ে যান।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ মুসলিম নেতাদের রাজনীতির গুরুত্ব অনুধাবন করায়, এবং তখন একজন মহান ব্যক্তি মুসলমানদের জন্য একটি রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ নেন। তিনি ছিলেন **নবাব স্যার সলিমুল্লাহ**, যিনি ১৯০৬ সালে ঢাকায় মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিম লীগ **মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ**র নেতৃত্বে ভারতের মুসলিম জনসংখ্যাকে হিন্দু মহাসভার কবল থেকে রক্ষা করে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের জন্ম দেয়। ইতিহাস তাঁকে যথার্থভাবেই ভারতের মুসলমানদের ত্রাণকর্তা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
যদিও পাকিস্তান মধ্যবিত্ত সমাজ গঠনের জন্য যথেষ্ট সুযোগ সৃষ্টি করেছিল, তবু পূর্ববাংলার মানুষ তাতে সুখী হতে পারেনি। অচিরেই আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন শুরু করেন এবং অবশেষে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে স্বাধীনতা অর্জিত হয়।
বাংলাদেশ জন্ম নিল, কিন্তু যেসব স্বপ্ন পূরণের জন্য আমরা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করেছি, সেগুলো বাস্তবায়িত হয়নি। অনেকে মনে করেন, এটি ছিল ভারতের ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে পাকিস্তানকে দুর্বল করার ষড়যন্ত্র। প্রকৃতপক্ষে আমরা ভারতের দাসে পরিণত হলাম। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সমাজজুড়ে এক গভীর সংকটের আবির্ভাব ঘটে। শেখ মুজিব না জাতিকে রক্ষা করতে পেরেছিলেন, না নিজের জীবন।
এরপর **জিয়াউর রহমান** ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হন, কিন্তু তিনিও নিজের জীবন রক্ষা করতে পারেননি। তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে জাতি রক্ষা পায়—তিনি আধুনিক বাংলাদেশের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং দেশকে ভারতের আধিপত্য থেকে মুক্ত রাখেন। জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর থেকে জানুয়ারি ২০০৭ পর্যন্ত ভারতের প্রভাব দৃশ্যমান ছিল না এবং জনগণও তা নিয়ে খুব একটা চিন্তিত ছিল না।
কিন্তু **জেনারেল মইনউদ্দিন** নিজের নিরাপদ প্রস্থান নিশ্চিত করতে ভারতের আধিপত্য আবার ফিরিয়ে আনেন এবং ডিসেম্বর ২০০৮-এ ক্ষমতা হস্তান্তর করেন **শেখ হাসিনার** হাতে। জাতিকে তখন এক অন্ধকার ফ্যাসিবাদী শাসনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, যা ২০২৪ সালের ৫ আগস্টে শেষ হয়। যদিও দেশ মুক্ত হয়েছে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসন এবং ভারতের প্রভাব থেকে, তবু এখনো তা অশুভ শক্তির কবল থেকে পুরোপুরি মুক্ত নয়।
জাতিকে শত্রুমুক্ত নিরাপদ করতে জনগণের ঐক্য অপরিহার্য, এবং এজন্য একজন দূরদর্শী ও সাহসী নেতার তীব্র প্রয়োজন। **ড. ইউনুস** রাজনীতিতে কিছু পরিবর্তনের চেষ্টা করছেন, কিন্তু একটি নিরাপদ বাংলাদেশের দৃঢ় ভিত্তি গড়তে তা যথেষ্ট নয়।
বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলো প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের বিষয়ে ঐক্যবদ্ধ নয়, যা একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার জন্য অপরিহার্য। **বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি**–কে একত্রে কাজ করতে হবে একটি সাংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা গঠনের জন্য, যা জনগণের আকাঙ্ক্ষা পূরণ করবে। তাদের মনে রাখতে হবে—জাতীয় জীবনের এই সংকটময় মুহূর্তে ব্যর্থতার কোনো সুযোগ নেই।
আগামী পাঁচ বছর তাদের এমনভাবে কাজ করতে হবে যেন তারা একক নেতার মতো আচরণ করে, যতক্ষণ না দেশ একটি নিরাপদ ভিত্তিতে দাঁড়ায়। জাতি চায় তারা জনগণ ও দেশের স্বার্থে একসাথে কাজ করুক, কারণ শত্রুরা এখনও সক্রিয় আমাদের ঐক্যের মাধ্যমে অর্জিত বিজয়কে নস্যাৎ করতে। তাদের সামনে কোনো বিকল্প নেই—তাদেরই এখন জাতিকে বর্তমান সংকট থেকে উদ্ধার করতে হবে, একজন সত্যিকারের ত্রাণকর্তা হিসেবে।